ভারতীয় সময় বিকাল সওয়া ৪টেয় প্যারিসের শতেরুর শুটিং রেঞ্জে যখন ভারতের জাতীয় পতাকা উঠছে তখন তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তিনি। চোখ ছলছলে। মুখে হাসি। বিজয়ীর হাসি। কয়েক মিনিট আগে দক্ষিণ কোরিয়া, চিনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে টান টান লড়াই করেছেন। .১ স্কোরের ব্যবধানে রুপো হাতছাড়া হয়েছে। ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছেন মনু ভাকের। ভারতের প্রথম মহিলা শুটার হিসাবে অলিম্পিক্সে পদক জিতেছেন তিনি। পদকের মঞ্চে দাঁড়িয়ে কি মনুর মনে পড়ে যাচ্ছিল তিন বছর আগের কথা? টোকিয়ো অলিম্পিক্সের কথা? সেখানে বন্দুক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়েছিলেন। পরের তিন বছরে নানা বিতর্ক সামলেছেন। বদমেজাজি তকমা ঘুচিয়েছেন। আসলে গত তিন বছরে জীবনটাই বদলে গিয়েছে তাঁর।
যোগ্যতা অর্জন পর্বে তৃতীয় স্থানে শেষ করেছিলেন মনু। রবিবার ফাইনালেও সেই তৃতীয় স্থানেই শেষ করলেন তিনি। শেষ শটের আগে ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। শেষ শটে মনু মারেন ১০.৩। চিনা প্রতিযোগী ১০.৫ মারায় মনুর রুপো পাওয়ার আশা শেষ হয়ে যায়। নিজের শট মেরে চুপ করে অপেক্ষা করছিলেন মনু। চিনা প্রতিযোগী বেশি মারার পরে মুচকি হাসলেন তিনি। বোধ হয় মনকে বোঝালেন, তিনি নিজের সেরাটা দিয়েছেন। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে। গত কয়েক বছরে এ ভাবেই ভাবতে শিখেছেন তিনি। পরে মিক্সড জ়োনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সেটাই বললেন ভারতের পদকজয়ী কন্যা।
শুটিংয়ে ১২ বছরের খরা কাটিয়েছেন মনু। তিনি জানিয়েছেন, এই পদক প্রাপ্য ছিল ভারতের। মনু বলেন, “ভারত অনেক দিন ধরে এই পদকের অপেক্ষা করেছিল। আমার হাত দিয়ে সেটা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করব আরও বেশি পদক জেতার। দলের সকলেই খুব পরিশ্রম করেছে। আমিও খুব পরিশ্রম করেছি। শেষ শটেও শরীরের সব শক্তি দিয়ে লড়ার চেষ্টা করেছি। পরের বার আরও ভাল করার চেষ্টা করব।”
গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন নিজের কর্ম করতে। সেই উপদেশ মেনে চলেন মনুও। তিনি বলেন, “আমি গীতা পড়েছি। ফাইনালের একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই কথাই ভাবছিলাম। শুধু নিজের কাজটা করেছি। বাকিটা নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছি। গীতায় অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘কর্ম করে যাও, ফলের আশা কোরো না।’ সেটাই করার চেষ্টা করেছি।”তিন বছর আগে পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ছোট থেকে মনুর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তাঁকে ধোঁকা দেয়। বিদ্রোহ করে বসে তাঁর হাতিয়ার। বন্দুক খারাপ হয়ে যাওয়ায় যোগ্যতা অর্জন পর্ব শেষ করতে পারেননি মনু। হতাশায় মুখ ঢেকেছিলেন। শুটিং রেঞ্জেই ডুকরে কেঁদেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কোচের কাঁধে মাথা রেখে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কী হয়েছিল মনুর বন্দুকে? বাবা রামকিশন ভাকের জানিয়েছিলেন, দ্বিতীয় সিরিজ়ের মাঝামাঝি মনুর বন্দুকে ইলেকট্রনিক ট্রিগারে সমস্যা দেখা দেয়। লিভার হয় খুলছিল না বা বন্ধ হচ্ছিল না। উপায় না দেখে এক বিচারক এবং কোচের সঙ্গে তাঁবুতে ফিরে বন্দুক বদলান। সেটি পরীক্ষা করার পর শুটিং রেঞ্জে ফিরে আসেন। তত ক্ষণে সময় নষ্ট হয়েছে। তার থেকেও বড় ব্যাপার, মনঃসংযোগে বিরাট ছেদ পড়েছে, যা শুটিংয়ের মতো ইভেন্টে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম সিরিজ়ের শেষে পঞ্চম স্থানে ছিলেন মনু। দ্বিতীয় সিরিজ়ে অষ্টম স্থানে শেষ করেন। এর পর ধীরে ধীরে পিছোতে থাকেন। ছ’টি সিরিজ় শেষে ১২তম স্থানে শেষ করেন।